এখন পর্যন্ত কত টাকা পেয়েছেন?’
জবাব এল, ‘কন্ট্রাক্ট পেপারই পাইনি। টাকা পাব কোত্থেকে!’
কাল মুঠোফোনে কথোপকথনটা হচ্ছিল চিটাগং কিংসের এক খেলোয়াড়ের সঙ্গে। গতকালের ম্যাচটিসহ এবারের বিপিএলে পাঁচ ম্যাচ খেলে ফেললেও ফ্র্যাঞ্চাইজির কাছ থেকে কাল পর্যন্ত কোনো টাকা পাননি ওই খেলোয়াড়। এ নিয়ে তাঁর মধ্যে কোনো অনিশ্চয়তাও দেখা গেল না অবশ্য, ‘ফ্র্যাঞ্চাইজির প্রতি আস্থা আছে আমাদের। আমি না পেলেও কেউ কেউ কিছু টাকা পেয়েছে। আমরাও পেয়ে যাব আশা করি।’
তাহলে কন্ট্রাক্ট পেপারের আলোচনাটা আসছে কেন? আরও দু–একটি ফ্র্যাঞ্চাইজির সঙ্গে কথা বলে যা জানা গেল, শুরু থেকে এই পর্যন্ত সব বিপিএলেই খেলোয়াড়েরা টুর্নামেন্ট খেলতে শুরু করেন আনুষ্ঠানিক চুক্তি সই করা ছাড়া। কারণ, বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিল থেকে সব ফ্র্যাঞ্চাইজিকে যে চুক্তিপত্র সরবরাহ করার কথা, সেটি পাঠানোই হয় টুর্নামেন্টের মাঝপথে বা শেষের দিকে। এবার যেমন এখন পর্যন্ত ফ্র্যাঞ্চাইজিরা চুক্তিপত্র হাতে পায়নি। যথারীতি মুখে মুখেই চলছে কাজকর্ম; যদিও সবকিছু হওয়ার কথা গভর্নিং কাউন্সিল, ফ্র্যাঞ্চাইজি ও খেলোয়াড়দের মধ্য ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে।
মজার ব্যাপার হলো, চুক্তিপত্র নিয়ে গভর্নিং কাউন্সিলের এমন সনাতন পদ্ধতিতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে সব ফ্র্যাঞ্চাইজি ও খেলোয়াড়েরা। খেলোয়াড়দের টাকা যথাসময়ে না দেওয়া বা একেবারেই না দেওয়ার ক্ষেত্রে কিংবা বকেয়া আদায়ের ক্ষেত্রেও নাকি চুক্তিপত্রের কোনো ভূমিকা দেখা যায় না।
চিটাগং কিংসের ওই খেলোয়াড় বিষয়টা সামনে আনলেন বিপিএলের সার্বিক এই চিত্র তুলে ধরতেই। যেখানে আয়োজকেরাই চুক্তি–টুক্তির বিষয়গুলো নিয়ে এমন উদাসীন, সবার কাছে চুক্তিপত্র মানে এক গোছা কাগজমাত্র; সেখানে সবকিছু ঢিলেঢালা, অনিয়মতান্ত্রিক আর অপেশাদারভাবে চলবে, এটাই স্বাভাবিক ধরে নিয়েছেন সবাই।
খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক সময়মতো না দেওয়াটা বিপিএলের মজ্জাগত দোষে পরিণত হয়েছে। এই সমস্যার কোনো সমাধানই যেন নেই! টুর্নামেন্টের ওপরে রংচঙের অভাব থাকবে না, কিন্তু ভেতরটা ফাঁকা। নিয়ম না মানাটাই এখানে নিয়ম এবং এটাকেই স্বাভাবিক ধরে নিয়ে চলবে সবকিছু। একসময় টুর্নামেন্ট শেষ হয়ে যাবে, রয়ে যাবে তবু তার রেশ। অমুকে টাকা পায়নি, তমুককে অর্ধেক টাকা দেওয়া হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
এবারও সেই ধারা অব্যাহত থাকবে বলেই মনে হচ্ছে। যত দূর জানা গেছে, ‘অলিখিত’ চুক্তির শর্ত মেনে বেশির ভাগ দলই এখনো স্থানীয় ক্রিকেটারদের পুরো ৫০ শতাংশ টাকা দেয়নি। রংপুর রাইডার্স ও সিলেট স্টাইকার্স ২৫ শতাংশ করে টাকা দিয়েছে বলে জানিয়েছে সূত্র। ফরচুন বরিশালের কাছেও ক্রিকেটারদের টাকা বাকি আছে। চিটাগং কিংসের কেউ কিছু পেয়েছেন, কেউ কিছুই পাননি। তবে ঢাকা ক্যাপিটালসের একাধিক ক্রিকেটার নিশ্চিত করেছেন তাঁরা ৫০ শতাংশ টাকা পেয়েছেন। খুলনা টাইগার্সও ৪০–৫০ শতাংশ টাকা দিয়ে দিয়েছে বলে দলের ক্রিকেটাররাই বলেছেন।
টাকার দাবিতে পরশু খেলোয়াড়েরা অনুশীলন বয়কট করার পর দুর্বার রাজশাহী কাল রাতেই ২৫ শতাংশ টাকা নগদ পরিশোধ করেছে, দেওয়ার কথা আরও ২৫ শতাংশের চেক। তার আগে পরশু অনুশীলন বয়কটের ঘটনার পর বিসিবির কাছ থেকে তারা ফ্র্যাঞ্চাইজি বাতিলের সতর্কবার্তাও পেয়েছে। অবশ্য ফ্র্যাঞ্চাইজির দাবি, অনুশীলন বয়কটের খবর সঠিক নয়। সব খেলোয়াড় তখনো চট্টগ্রামে টিম হোটেলে না ওঠায় টিম ম্যানেজেমেন্টই সেদিন দলকে বিশ্রাম দিয়েছিল।
টাকাপয়সা নিয়ে যখন বেশিরভাগ ফ্র্যাঞ্চাইজিতেই ঝামেলা, তখন শুধু রাজশাহীর খেলোয়াড়েরাই কেন এ নিয়ে প্রতিবাদমুখর হলেন, কেন তাঁদের বিষয়টিই সামনে এল-সেটা একটা প্রশ্ন।
শর্ত অনুযায়ী টাকা না পেলেও অনেক ফ্র্যাঞ্চাইজির ক্রিকেটাররাই এটাকে বড় কোনো সমস্যা হিসেবে সামনে আনতে চাচ্ছেন না। পেটে বোমা মেরেও শুধু আমতা–আমতা সূচক শব্দই বের করা যাচ্ছে। তাহলে রাজশাহীর ক্রিকেটারেরা প্রকাশ্য প্রতিবাদে নেমে পড়লেন কেন? বিপিএলের বাস্তবতায় প্রশ্নটা আসেই।
রাজশাহীর ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিকানা নিয়ে জটিলতার যে গুঞ্জন, সেটাই কি ইন্ধন দিচ্ছে এতে? নাকি অন্য ফ্র্যাঞ্চাইজির ক্রিকেটাররা যে টাকাপয়সা না পেয়েও সেটাকে স্বাভাবিক ধরে নিয়ে ফ্র্যাঞ্চাইজির ওপর আস্থা দেখাচ্ছেন, অস্বাভাবিকতা সেখানে? সেটিই যদি হয়, তাহলে তো বিপিএল নিয়ে আরও বড় শঙ্কাই সামনে আসে।
যে যাই বলুন, এ জাতীয় টুর্নামেন্টের মূল উদ্দেশ্যই হলো ব্যবসা, অর্থ উপার্জন। খেলোয়াড়েরা খেলে, ফ্র্যাঞ্চাইজিরা খেলিয়ে এবং আয়োজকেরা টুর্নামেন্ট আয়োজন করে আয় করবে। কিন্তু আয়ের চেনা উৎসগুলো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলে এবং তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন না তুললে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক-প্রত্যাশিত আয়টা অন্য কোনোভাবে আসছে না তো? আর যাই হোক, ‘ব্যবসা’ করে কেউ তো লস দিতে চাইবে না!