জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচনে বাধা কোথায়?
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ বলছে, দেশের ৬৫ শতাংশ মানুষ ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন চান। রাজনৈতিক দলগুলোর ভাবনা আবার ভিন্ন। বিএনপিসহ বড় দলগুলো মনে করছে, এ মুহূর্তে জাতীয় অগ্রাধিকার সংসদ নির্বাচন। ইসিও কথা বলছে অনেকটা একই সুরে। তবে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন প্রধান।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ সব জায়গায় এক ধরনের স্থবিরতা চলছে। দলীয় বিবেচনায় নির্বাচিতরা অধিকাংশই সরকার পতনের পর থেকেই পলাতক। অনেকে গ্রেফতার হয়েছেন। পরে জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ করে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে (সিটি করপোরেশন, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও পৌরসভা) সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশাসক নিয়োগ দেয় অন্তর্বর্তী সরকার।
স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধির কাজ চালাচ্ছেন প্রশাসক
কাজের সুবিধার্থে এসব জায়গায় পূর্ণকালীন প্রশাসক বসানো হয়েছে। জনপ্রতিনিধিদের অনুপস্থিতিতে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে করপোরেশনের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাদের। এতে জন্ম-মৃত্যু সনদ, নাগরিক ও ওয়ারিশ সনদ পেতে বেগ পেতে হচ্ছে জনগণকে। অনেক সময় সরকারি কাজের জন্য কর্মকর্তাদের পাওয়া যায় না। তারা স্থানীয়দের চেনেন না। শনাক্ত করতে ব্যবহার করা হচ্ছে জটিল পদ্ধতি।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন জরুরি। মানুষ বর্তমানে অনেক সেবা থেকে বঞ্চিত। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আমি কোনো বাধা দেখছি না। রাজনৈতিক দলগুলো চাইলেই কোনো বাধা নেই। তবে সে ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে ইসিকে অনুরোধ করতে হবে আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার জন্য।- নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার।
আবার অতিরিক্ত দায়িত্বের চাপে সব কাজ ঠিকমতো তদারকিও করতে পারছেন না কর্মকর্তারা। এতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। তারা স্থানীয় সরকারের নির্বাচন আগে চাচ্ছেন। কারণ চলার পথে প্রতিনিয়ত প্রয়োজনীয় সনদগুলো পেতে তাদের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। তারা আগে এর সমাধান চান।
বিভিন্ন সনদ পেতে ভোগান্তি
মেহেরপুরের গাংনী পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম মাস্টার। এই ওয়ার্ডে জন্মসনদসহ নানান সেবা পেতে সবাইকে যেতে হচ্ছে গাংনী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) কাছে। এ এলাকার প্রশাসনিক কর্মকর্তা তিনি। সিরাজুল মাস্টারের ওয়ারিশ সনদ পেতে সময় লেগেছে চারদিন। কাউন্সিলর থাকলে হয়তো একদিনেই পেয়ে যেতেন বলে জানান তিনি।
একই পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘জন্ম-মৃত্যু ও নাগরিক সনদ পাওয়া এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ সেবার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এমন একজনকে যিনি ওয়ার্ডের লোকজনকে চেনেন না। এজন্য একটি জন্মসনদ নিতে ১০ দিনের বেশি লেগে যাচ্ছে। আগে যে কাজ কয়েক ঘণ্টায় হয়ে যেত।’
আগে পৌরসভার মেয়র বা কাউন্সিলরের কাছে গেলে দ্রুত সময়ে মিলতো সব সনদ। কিন্তু এখন একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। যে কোনো সনদ পেতে কমপক্ষে এক সপ্তাহ সময় লাগছে।
শরীয়তপুরের নড়িয়া পৌরসভার সাবেক মেয়র অ্যাডভোকেট আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘মানুষ সব সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সরকার প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছেন কিন্তু কাজ দ্রুত হচ্ছে না। ওয়ারিশ সনদ চাইলে এক সপ্তাহ লাগছে। কাউন্সিলর না থাকার কারণে কেউ কাউকে চেনে না। ফলে জটিলতা তৈরি হচ্ছে। একজন কাউন্সিলর যত দ্রুত নাগরিক সেবা দিতে পারবেন প্রশাসকের পক্ষে তা সম্ভব নয়। সুতরাং স্থানীয় সরকারসহ সব নির্বাচন দ্রুত হওয়া উচিত।’
বিবিএসের জরিপ
আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার বিষয়ে সমর্থন জানিয়েছেন ৬৫ শতাংশ মানুষ। জরিপটি পরিচালনা করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার প্রস্তাব তৈরির লক্ষ্যে গত ২০ থেকে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন এ জরিপ চালায়। ইতোমধ্যে জরিপের খসড়া প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।
দেশের আবহাওয়া একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এমন কোনো ঘটনা (ইভেন্ট) আসা ঠিক হবে না, যেটা জাতীয় নির্বাচন ব্যাহত করে। আমি নিশ্চিত মন্ত্রণালয়, সরকার, সংশ্লিষ্ট সবাই যেটা সিদ্ধান্ত নেবে, আমরা তা বাস্তবায়ন করবো। এতে সরকার যদি মনে করে কিছু নির্বাচন আগে করবো আমাদের সেভাবে করতে হবে।- নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ
জরিপে নমুনায়নের মাধ্যমে ৪৬ হাজার ৮০টি সাধারণ খানা (পরিবার বা যারা এক চুলায় রান্না করেন) থেকে উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। প্রতিটি খানা থেকে ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী নাগরিকদের মধ্যে ‘কিশ গ্রিড সিলেকশন’ পদ্ধতিতে একজন নির্বাচিত উত্তরদাতার কাছ থেকে নির্ধারিত প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। অর্থাৎ ৪৬ হাজার ৮০ জন মানুষ এই জরিপে অংশ নিয়েছেন।
‘আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কোনো বাধা দেখছি না’
জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কোনো বাধা দেখছেন না অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার। এটা রাজনৈতিক দলগুলোর চাওয়া-পাওয়ার ওপর নির্ভর করছে দাবি করে বদিউল আলম মজুমদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচন জরুরি। মানুষ বর্তমানে অনেক সেবা থেকে বঞ্চিত। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আমি কোনো বাধা দেখছি না। রাজনৈতিক দলগুলো চাইলেই কোনো বাধা নেই। তবে সে ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে ইসিকে অনুরোধ করতে হবে আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার জন্য।’
জাতীয় নির্বাচনের আগে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার পক্ষে রয়েছে জাতীয় নাগরিক কমিটিসহ বিভিন্ন সংগঠন ও দল। তারা বিবিএসের জরিপের ফলাফলকে যৌক্তিক বলে মনে করছে। তবে নির্বাচন কমিশন জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন চায় না।
যে বাধা দেখছে ইসি
জাতীয় নির্বাচনের আগে সংস্কার কমিশনের দেওয়া সুপারিশ ধারণ করে আইন-বিধিমালায় সংশোধন দরকার। এটাও একটা সময়সাপেক্ষ কাজ। জাতীয় নির্বাচনের আগে আবহাওয়া দেখতে হয়। বৃষ্টি ও ঝড়ের বিষয়টি মাথায় রাখতে হয় ইসিকে। এছাড়া জাতীয় নির্বাচনের আগে ইসি এমন কোনো কাজ করতে চায় না যা নির্বাচন ব্যাহত করে।
নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সামগ্রিক ফোকাস (মনোযোগ) হচ্ছে জাতীয় নির্বাচন। ইসি জাতীয় নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি থাকলে অপরাপর সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়ে যাবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাস্তবতা হচ্ছে, একটা সংস্কার কমিশন কাজ করছে। তাদের (সংস্কার কমিশন) প্রস্তাব সামনে আসবে। এটি ধারণ করে আইন-বিধিমালায় কোনো সংশোধন দরকার হলে সেটা করতে সময় লাগবে।’
তিনি বলেন, ‘দেশের আবহাওয়া একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এমন কোনো ঘটনা (ইভেন্ট) আসা ঠিক হবে না, যেটা জাতীয় নির্বাচন ব্যাহত করে। আমি নিশ্চিত মন্ত্রণালয়, সরকার, সংশ্লিষ্ট সবাই যেটা সিদ্ধান্ত নেবে, আমরা তা বাস্তবায়ন করবো। এতে সরকার যদি মনে করে কিছু নির্বাচন আগে করবো আমাদের সেভাবে করতে হবে।’
আমি যেহেতু একটা কমিশন নিয়ে কাজ করছি সুতরাং কোনো মন্তব্য করবো না। তবে বদিউল আলমের সুপারিশে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে স্থানীয় সরকার নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের আগে হওয়া দরকার।- স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান প্রফেসর ড. তোফায়েল আহমেদ
এই নির্বাচন কমিশনার আরও বলেন, ‘আমাদের সিদ্ধান্ত হলো সব নির্বাচন একসঙ্গে করা সম্ভব নয়, স্থানীয় সরকার নির্বাচনও একসঙ্গে করা সম্ভব নয়, বাস্তবসম্মতও নয়। সরকার চাইলে জাতীয় নির্বাচনের আগে আমরা স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে পারবো। স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে সরকারের তরফ থেকে ইসি কোনো অনুরোধ পায়নি। পত্রপত্রিকায় যেহেতু বিষয়টি নিয়ে লেখালেখি ও আলোচনা হচ্ছে, এ কারণে কমিশন নিজ থেকেই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছে।’
আগে জাতীয় নির্বাচন চায় বিএনপি
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বক্তব্যে বারবার দ্রুত সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের প্রসঙ্গ আসছে। তারা কোনোভাবেই স্থানীয় সরকারের নির্বাচন আগে চান না।
দলটির কেন্দ্রীয় বিএনপির নির্বাহী কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আহমেদ আযম খান সম্প্রতি টাঙ্গাইলের একটি অনুষ্ঠানে বলেন, আপনারা কেউ কেউ রাজনৈতিক দল গঠন করতে চান, তাদের স্বাগতম। গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দল আছে। নতুন নতুন রাজনৈতিক দল আসতে কোনো বাধা নেই, বরং স্বাগত জানাই। কিন্তু আপনাদের রাজনৈতিক দল হবে। তারপর কয়েক বছরে ওটা দাঁড়াবে। তারপর নির্বাচন- এসব চটকদারি কথা বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে পারবেন না।
তিনি বলেন, জনগণ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দেওয়ার জন্য মুখিয়ে আছে। আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন চায়। কোনো স্থানীয় সরকার নির্বাচন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে হবে না। প্রয়োজনীয় অত্যাবশ্যকীয় সংস্কার শেষ করে এ বছরই নির্বাচনের আয়োজন করুন।
সব দল মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে গণ অধিকার পরিষদ
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাজনৈতিক দলগুলোকে ডেকে যে সিদ্ধান্ত নেবেন তাতেই রাজি গণ অধিকার পরিষদ (জিওপি)। দলটির সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার উচিত হবে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নেওয়া। অন্যথায় সবার মধ্যে মতপার্থক্য থাকবে। উপদেষ্টাকে উদ্যোগ নিতে হবে। দল হিসেবে আমরা চাই জাতীয় ঐক্য সংহতি প্রতিষ্ঠা করা। পুনরায় ঐক্য ও সংহতি ফিরিয়ে আনা উচিত। ঐক্য না থাকলে দেশ পিছিয়ে যাবে। আমার চাওয়া জাতিকে ঐক্য করা। আমার চাওয়া নিজেদের মধ্যে বিভেদ না থাকা। যাতে আর কোনোদিন আওয়ামী লীগ এই দেশে প্রতিষ্ঠিত না হতে পারে। স্থানীয় নির্বাচন আগে না পরে হবে সবাই যে সিদ্ধান্ত নেবে তাতেই আমরা রাজি।’
যা বলছেন স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান
তবে স্থানীয় নির্বাচন জাতীয় নির্বাচন আগে বা পরে হওয়া নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে হতে বাধা কোথায়? এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান প্রফেসর ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘আমি যেহেতু একটা কমিশন নিয়ে কাজ করছি সুতরাং কোনো মন্তব্য করবো না। তবে বদিউল আলমের সুপারিশে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে স্থানীয় সরকার নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের আগে হওয়া দরকার।’
ইসি বলছে, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন করা সমীচীন নয়? এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা আমি বলতে পারবো না। এটা ইসিকে জিজ্ঞেস করেন তারা কেন এটা বলেছে।’
স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে হওয়া উচিত কি না? আমি যেহেতু ‘একটা কমিশনের হয়ে কাজ করছি সুতরাং এখন কিছু বলতে পারবো না।’