বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫, ০৯:২১ অপরাহ্ন

ভেজালে বাজার হারাচ্ছে রাজশাহীর খেজুর গুড়, বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি

অনলাইন ডেঙ্ক / ৬ দেখেছেন:
আপডেট : শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২৪

খেজুরের গুড় তৈরি হচ্ছে অথচ তাতে নেই খেজুরের রস। এ গুড়ের উপাদান ঝোলা গুড়, অপরিশোধিত ভারতীয় চিনি-গুড়, রং, আটা, রাসায়নিক ও ভেষজ নির্যাস। রাজশাহীতে প্রতি বছর খেজুর গাছের সংখ্যা কমলেও বাড়ছে গুড় উৎপাদন। জেলার চারঘাট, বাঘা ও পুঠিয়া উপজেলার আনাচে কানাচে গড়ে উঠেছে ভেজাল গুড় তৈরির কারখানা। প্রতিদিন শত শত মণ গুড় রাজশাহীর আশেপাশের জেলাসহ যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এতে যেমন রাজশাহীর গুড়ের সুনাম নষ্ট হচ্ছে তেমনি বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শীত এলেই রাজশাহীর এক শ্রেণির মৌসুমি ব্যবসায়ীরা কারিগরদের ভাড়া করে ভেজাল খেজুরের কারখানা খুলে বসেন। রাতারাতি প্রতিটি কারখানায় ২০০-৩০০ কেজি গুড় তৈরি করা হয়। গত ১৩ ডিসেম্বর বাঘা উপজেলার আড়ানী দিয়াড়পাড়া গ্রামে অভিযান চালিয়ে ৬০০ কেজি ভেজাল খেজুর গুড়, নিম্নমানের অপরিশোধিত ভারতীয় চিনি-গুড় ও রাসায়নিক দ্রব্য ধ্বংস করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বর্তমানে চারঘাটে ১ লক্ষ ৮০ হাজার ২৭৫টি, পুঠিয়ায় ৫ লক্ষ ৭০ হাজার ১২৫টি ও বাঘায় ১ লক্ষ ২০ হাজার ৫১২টি খেজুর গাছ রয়েছে। তবে প্রতি বছরই এসব উপজেলায় গড়ে ৪-৬ হাজার গাছ কমছে। এই তিন উপজেলা সংলগ্ন রাজশাহীর সবচেয়ে বড় খেজুর গুড়ের হাট বসে পুঠিয়ার বানেশ্বর বাজারে। প্রতিদিন এই হাটে প্রায় ১০০ থেকে ১১০ টন এবং সপ্তাহে দুদিন বড় হাটে ১২০ থেকে ১৫০ টন গুড় আমদানি হয়। এছাড়াও চারঘাটের বাঁকড়া ও নন্দনগাছী, বাঘার বিনোদপুর, মনিগ্রাম ও আড়ানী এবং পুঠিয়ার ঝলমলিয়া হাটে শত শত টন গুড় কেনাবেচা হয়। প্রতিদিন ভোর থেকে ভ্যান, নসিমনসহ বিভিন্ন যানবাহনে আশেপাশের এলাকা থেকে এই হাটে গড় আমাদানি হয়। কিন্তু কি দিয়ে তৈরি হচ্ছে এত খেজুরের গুড়? আর এ গুড়ে কি খেজুরের রস থাকে? এসব প্রশ্ন এখন মানুষের মুখে মুখে।
সরেজিমন চারঘাট, বাঘা ও পুঠিয়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির আনাচে কানাচে গড়ে উঠেছে গড়ে উঠেছে খেজুর গুড় তৈরির কারখানা। সেখানে টিনের কড়াইয়ে ভারতীয় অপরিশোধিত চিনি–গুড়ভর্তি টিন কেটে পিচ পিচ করা হচ্ছে। সেই কড়াইয়ে দেওয়া হচ্ছে ১০-১২ কেজি ঝোলা খেজুর গুড়। কিছুক্ষণ জ্বাল দেওয়ার পর অপরিশোধিত চিনি–গুড়ের দলা ঝোলা গুড়ের সাথে মিশে যাচ্ছে। তখন মেশানো হচ্ছে খেজুর গুড়ের নির্যাস, রং, রাসায়নিক দ্রব্য ও আটা। এভাবেই তৈরি হচ্ছে খাঁটি খেজুরের গুড়। দিন-রাত প্রকাশ্যেই চলছে ভেজাল মেশানোর কাজ।
টিনভর্তি অপরিশোধিত এসব চিনি–গুড় ভারত থেকে আমদানি করা হয় দাবি কারখানা মালিকদের। তাঁরা বলেন, গত বছর থেকে গুড় তৈরিতে এটি ব্যবহার করা হচ্ছে। এর আগে প্রতি মণ গুড় তৈরিতে খেজুর রস কিংবা ঝোলা গুড়ের সাথে ৫-১০ কেজি চিনি দেওয়া হতো। এখন প্রতি মণ গুড়ে ভারতীয় এসব অপরিশোধিত চিনি–গুড়ের পুরো এক টিন দেওয়া হয়।
প্রতিটি টিনে প্রায় ২২ কেজি উপকরণ থাকে। একটি টিনের সাথে ১০-১২ কেজি ঝোলা গুড়, আটা ও রাসায়নিক মেশালেই এক মণ গুড় তৈরি হয়। প্রতি কেজি অপরিশোধিত চিনি-–গুড় ৭০-৮০ টাকা কিন্তু বাজারের খেজুরের গুড় ১৮০-২০০ টাকা। তাতে তিনগুন লাভ করা সম্ভব। প্রকৃত খেজুর গুড় তৈরির কারিগররা বলছেন, প্রাকৃতিক কারণেই খেজুর গাছে আগের মত রস হয় না। রসের পরিমাণ কম হওয়ায় খাটি গুড় তৈরি করা কষ্টসাধ্য। গুড়ের পরিমাণ বাড়াতে অনেকে রসের সঙ্গে অর্ধেক পরিমাণ চিনি মিশিয়ে গুড় তৈরি করছেন। তাতেও খেজুরের রসের স্বাদ কিছুটা পাওয়া যায়। কিন্তু কারখানা মালিকরা গাছিদের কাছে থেকে রস ও ঝোলা গুড় কিনে নিয়ে কারখানায় যে গুড় তৈরি করছে তাতে
রাসায়নিক ভেষজের কারণে ঘ্রাণ থাকলেও স্বাদ নেই। ভেজাল গুড়ে বাজার সয়লাবের কারণে আসল গুড়ের কদর নেই। এজন্য বাধ্য হয়ে চাষীরা গুড় তৈরি না করে কারখানা গুলোর কাছে রস ও ঝোলা গুড় বিক্রি করে দিচ্ছে।
চারঘাট উপজেলার নিমপাড়া গ্রামের কৃষক আব্দুল কাদের বলেন, ভেজাল গুড়ে ভেজষ নির্যাস মেশানোর কারণে আসল গুড়ের চেয়ে ঘ্রাণ বেশি। বাজারে আসল ও ভেজাল সবগুড়ের একই দাম। বরং আসল গুড় তৈরি করা কঠিন কাজ। এজন্য গুড় তৈরি না করে রস লিটারের দামে ও ঝোলা গুড় কেজি হিসাবে কারখানা গুলোর কাছে বিক্রি করে দিচ্ছি। কারখানাগুলো অগ্রীম টাকা দিয়ে রস ও ঝোলা গুড় কিনছে।
বাঘা উপজেলার মীরগঞ্জ এলাকার খেজুর গাছি রফিকুল ইসলাম বলেন, খেজুর গুড়ের সেই স্বাদ ও গন্ধ আর নেই। কারখানাগুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে আমরা টিকতে পারছিনা। আমরা ১০ কেজি গুড় তৈরিতেই ক্লান্ত, অথচ তারা প্রতিদিন ৫-১০ মণ গুড় তৈরি করছে। প্রশাসন অভিযান দিলেও পরদিনই আবার চালু হয় কারখানা। অনলাইনে অগ্রানিক গুড় বিক্রেতা ওবাইদুর রহমান বলেন, গত পাঁচ বছর হলো অনলাইনে গুড় বিক্রি করি। আগে রাজশাহীর নাম শুনলেই ক্রেতারা হুমড়ি খেয়ে পড়তো, কিন্তু এখন ক্রেতারা প্রতারিত হয়ে আগ্রহ হারিয়েছে। আমরা চাষীদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে আসল গুড় তৈরি করে ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দিই। কিন্তু বাজারে থাকা ভেজাল গুড়ের সাথে দামের পার্থক্য থাকায় অনেকেই নিতে চায় না।
পুঠিয়ার বানেশ্বর বাজারের পাইকারি গুড় ব্যবসায়ী সুফেল রানা বলেন, গুড় পাইকারি ভাবে কিনে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠাই। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত ভেজাল গুড় তৈরির কারণে রাজশাহীর কোটি কোটি টাকার গুড়ের ব্যবসা এখন ক্ষতির মুখে। প্রতি বছরই গুড়ের বাজার বড় হচ্ছে কিন্তু সুনাম হারাতে বসেছে এ অঞ্চলের গুড়। ভেজাল চলতে থাকলে রাজধানীসহ বড় বাজার গুলোতে রাজশাহীর গুড় অচল হয়ে পড়বে।
এদিকে ভেজাল গুড় তৈরির কারখানা গুলোতে ব্যাপক পরিমাণে ভারতীয় অপরিশোধিত চিনি–গুড়ের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় চারঘাট, বাঘা ও পুঠিয়ার মোড়ে মোড়ে গড়ে উঠেছে আড়ত। ভারতীয় টিন আমদানিকারক চারঘাটের পরানপুর এলাকার মজনু আলী বলেন, মানুষের খাবারের জন্যই টিনের প্যাকেটে থাকা সেমি লিকুইড গুড় আমদানি করি। দেখতে অনেকটা চিনির দলার মত। কারখানাগুলো এই টিন কিনে নিয়ে গিয়ে কি করে সেটা দেখার দায়িত্ব আমাদের না।
চারঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. আশিকুর রহমান বলেন, গুড়ের সাথে কোনো কিছু মেশানো ঠিন না। কেমিক্যাল মিশ্রিত গুড় খেলে আলসার, ডায়রিয়া, কলেরাসহ পেটের নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। শিশুদের কোনো খাদ্য তৈরি করে খাওয়ালে শিশুরা কিডনি, হার্ট, ব্রেণ ও লিভার ক্যান্সারের মতো ভয়াবহ জটিল রোগেও আক্রান্ত হতে পারে।
চারঘাট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আল মামুন হাসান বলেন, খেজুর গাছের সংখ্যা কমলেও গুড়ের উৎপাদন বেড়েছে।কারখানাগুলোতে নিম্নমানের সাদা ও লাল রংয়ের অপরিশোধিত চিনি-গুড় মেশানো হচ্ছে। এতে গুড়ের কোনো গুনগত মান থাকছেনা। এতে এই আঞ্চলের প্রকৃত খেজুর গুড় উৎপাদনকারীরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। গুড়ের সুনাম ডুবতে বসেছে। এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের রাজশাহীর সহকারী পরিচালক বিপ্লব বিশ্বাস বলেন, ভেজাল গুড় তৈরি বন্ধে আমরা চারঘাট-বাঘা ও পুঠিয়া এলাকায় অনেকগুলো পরিচালনা করেছি। নতুন কিছু কারখানার তথ্য আমরা পেয়েছি। সে অনুযায়ী খুব দ্রুত অভিযান পরিচালনা করা হবে।

 


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো দেখুন..
এক ক্লিকে বিভাগের খবর