এক সময়ের জোটসঙ্গী বিএনপি-জামায়াত এখন মুখোমুখি। দেড় যুগ আগে ৫ বছর একসঙ্গে সরকারে থাকা দল দু’টির নেতাদের মধ্যে প্রায়শই বাকযুদ্ধ হচ্ছে। তারা পরস্পরের প্রতি শক্তিশালী ‘শব্দবোমা’ ছুড়ছেন। তাদের এই প্রতিযোগিতার নেপথ্যে কী? হ্যাঁ, ক্ষমতা।
টানা ১৫ বছর আওয়ামী শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট ছিল উভয়ে। ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত অভ্যুত্থান মুক্তভাবে তাদের নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ করে দিয়েছে। আগস্টের দিনগুলোতে দল দু’টির নেতাদের বয়ানে সেটির শর্তহীন স্বীকারোক্তি রয়েছে। কিন্তু ভোটের সময় যত ঘনিয়ে আসছে ততই নয়া নয়া বয়ান হাজির করছেন ক্ষমতার সিঁড়িতে অপেক্ষমাণ দল দু’টির নেতারা। রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের মতে, ক্ষমতার সিঁড়ি স্থির নয়, এটি চলন্ত। পতিত সরকারের আমলে তৈরি হওয়া মেট্রো স্টেশনের সিঁড়ির মতো।
ভোটের রাজনীতিতে পোক্ত অবস্থানের কারণে মধ্যপন্থি দল বিএনপি সেই চলন্ত সিঁড়ির সামনে। কর্তৃপক্ষের ঘোষণা মেনে তারা সিঁড়িটির এক পাশে দাঁড়িয়ে। কয়েক ধাপ পেছনে ইসলামপন্থি দল জামায়াত। ইমার্জেন্সি দেখিয়ে তারা সামনে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
ছুটছে গতি নিয়ে। কিন্তু বাধাতো অনেক। ক্ষমতার প্ল্যাটফরমে যাওয়ার চলন্ত সিঁড়িটিতে আরও কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে গেছেন। তাদের অনেকেই হাসিনা আমলে নির্যাতন-বঞ্চনার শিকার। ছাত্র-জনতার সফল আত্মত্যাগের অংশীদার। ৩৬ জুলাই খ্যাত ৫ই আগস্টের ওই আন্দোলন সফলতা না পেলে ইতিহাস ভিন্নভাবে লেখা হতো। কতো মায়ের বুক খালি হতো, কতো লাশ বেওয়ারিশ দাফন হতো, কতো লোকের জীবন আয়নাঘর, কারাগার কিংবা বিদেশে ফেরারি অবস্থাতেই শেষ হতো তা ভবিষ্যৎবেত্তা একমাত্র স্রষ্টাই ভালো জানেন। কিন্তু আজ সেই কঠিন দিনগুলোকে বেমালুম ভুলতে বসেছে জয়ী বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃত্ব।
তবে হ্যাঁ, পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা সরকারের সুবিধাভোগীরা সেই আন্দোলনের প্রতিটি ফুটেজ রেখেছে বেশ যত্ন করে। তারা প্রতিশোধের অপেক্ষায় প্রতিটা প্রহর গুনছে। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াত উভয়ের সমর্থন ছিল। এটা অস্বীকারের কোনো উপায় নেই। এক সময় এটাকে বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলন বলে কামান-এপিসি দিয়ে ধূলিসাৎ করে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিল দম গলার কাছে থাকা শেখ হাসিনা সরকার। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি আন্দোলনে সাধারণ মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণের কারণে। আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছাত্র নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক এবং নাগরিক শক্তির অবদানকে স্বীকার করে দ্ব্যর্থহীনভাবে।
কিন্তু এটি কোনো অবস্থাতেই বিএনপি, জামায়াত বা কোনো প্রতিষ্ঠিত শক্তির সম্মিলিত কর্মসূচি বা যুগপৎ আন্দোলন ছিল না। ওই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থী এবং স্পষ্টত বিপরীত মেরুতে অবস্থান করা নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। তাদের মধ্যে বিএনপি এবং তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল এবং জামায়াত ও তার অনুগামী শক্তি ছাত্রশিবির ছিল। কিন্তু ব্যানার ছিল বৈষম্য বিরোধী।
একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্ট মতে, ওই আন্দোলনে দেশের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক শক্তিগুলোর স্টেইক সামান্য। এটি ছিল শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনবিরোধী সব মত ও পথের মানুষের ক্ষোভের বিস্ফোরণ। ছোট্ট স্ফুলিঙ্গ থেকে লসঅ্যানজেলেসের দাবানলের মতো ছড়িয়েছে মুহূর্তে।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এতে শেখ হাসিনা সরকারের রাজনৈতিক সুবিধাবঞ্চিত নিজ দলের নিরীহ সমর্থকদেরও এক ধরনের প্রচ্ছন্ন অংশগ্রহণ ছিল! যার প্রমাণ এলাকাভিত্তিক আন্দোলন। অর্থাৎ যাত্রাবাড়ী, রামপুরা-বনশ্রী, উত্তরা, মোহাম্মদপুর ও মিরপুরÑ ঢাকার এই ৫টি স্পটে পুলিশ, র্যাব ও আওয়ামী নেতৃত্বের সম্মিলিত বাধার মুখেও ছাত্র-জনতা রীতিমতো ব্যুহ তৈরি করে দিনরাত আন্দোলন চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।
আওয়ামী লীগের পতনের পর সঙ্গতকারণেই দেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি। তিনবার সরকার গঠন করা দলটি ফের ক্ষমতায় যাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কোথায় যেনো গোলমাল! সব কিছুই যেনো ওলটপালট। বিএনপি নেতাকর্মীর মধ্যে এক ধরনের তাড়াহুড়ো লক্ষণীয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগ এবং তাদের আশ্রয় ও প্রশ্রয়দাতা ভারতবিরোধী কার্ডের বড় স্টেইক বিএনপি’র। জামায়াতও সেই কার্ডের দাবি করতো। কিন্তু এখন উভয় দলের ভারতবিরোধিতা প্রায় শূন্যের কোঠায়।
বরং ৫ই আগস্টে রাজনীতিতে নতুন মেরূকরণ ঘটেছে। উল্লেখ্য, বিএনপি-জামায়াত দল দুটির গঠনতন্ত্র, কর্মসূচি মানুষের মাঝে অবস্থানে স্পষ্টত পার্থক্য রয়েছে। জামায়াতের নামের সঙ্গেই ইসলাম শব্দ যুক্ত। সারা বছর তারা ধর্মকে সামনে রেখেই সমুদয় কর্মসূচি পালন করে। এতে তাদের কোনো রাখঢাক নেই। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের অবস্থান স্বতন্ত্র। ভোটের মাঠে তাদের নিজস্ব অবস্থান রয়েছে।
অভ্যুত্থান পরবর্তী নয়া রাজনীতি বিশেষত আওয়ামী লীগের শূন্যস্থান পূরণের খেলায় কে কতোটা জায়গা করে নিতে পারে তা দেখার বিষয়। তবে এটা মানতে হবে যে, রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ওয়াকওভার দিলে এক, আর ডামি প্রার্থী দিলে হিসাব হবে অন্য। তখনই মিলবে আজকের দ্বান্দ্বিক অবস্থানে থাকা বিএনপি-জামায়াতের অংক।